Friday, July 4, 2025

বাংলাদেশে ‘এক কিডনির গ্রাম’

জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার বাইগুনি গ্রামে নিজের আধা-নির্মিত ইটের বাড়ির সামনে বসে আছেন ৪৫ বছর বয়সী সফিরুদ্দিন। পেটের ডান পাশে হালকা চাপ দিলে এখনো তীব্র ব্যথা অনুভব করেন তিনি। সেই অস্ত্রোপচারের চিহ্ন আজও শরীরে বহন করছেন সফিরুদ্দিন।

শুক্রবার (০৪ জুলাই) কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। এই বিশেষ রিপোর্টটি করেছেন জয়তী ঠাকুর, আমিনুল ইসলাম মিঠু ও হানান জাফর।

২৮২৪ সালে পরিবারের অভাব দূর করতে এবং তিন সন্তানের জন্য একটি ঘর তৈরির আশায় সফিরুদ্দিন নিজের একটি কিডনি বিক্রি করেন ভারতের এক ব্যক্তির কাছে। বিনিময়ে তিনি পেয়েছিলেন সাড়ে তিন লাখ টাকা। তবে সেই অর্থ অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। বাড়ির নির্মাণকাজ থেমে আছে দীর্ঘদিন ধরে। আর প্রতিদিনের শরীরের যন্ত্রণা তাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়- সেই সিদ্ধান্ত কতটা ভয়ংকর ছিল। বর্তমানে জয়পুরহাটের একটি হিমাগারে দিনমজুর হিসেবে কাজ করছেন সফিরুদ্দিন। অস্ত্রোপচারের পর দুর্বল হয়ে পড়া শরীর নিয়ে প্রতিদিনের পরিশ্রম এখন তার জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, ‘আমি সব করেছি আমার স্ত্রী আর সন্তানদের জন্য।’ শুরুতে ভয় থাকলেও, দালালদের আশ্বাসে ধীরে ধীরে রাজি হয়ে যান তিনি। পাসপোর্ট, ভিসা, বিমানযাত্রা থেকে শুরু করে হাসপাতালের যাবতীয় কাগজপত্র- সবই প্রস্তুত করে দেয় দালালচক্র। যদিও সফিরুদ্দিন মেডিকেল ভিসায় ভারতে যান, হাসপাতালের কাগজপত্রে তাকে দেখানো হয় ‘রোগীর আত্মীয়’ হিসেবে। এমনকি তার জন্য জাল পরিচয়পত্র, ভুয়া জন্মনিবন্ধন ও নোটারি সনদপত্রও তৈরি করা হয়। আর যার শরীরে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, সেই ব্যক্তির পরিচয় আজও অজানা সফিরুদ্দিনের কাছে। ভারতের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, কিডনি প্রতিস্থাপন শুধু নিকটাত্মীয়দের মধ্যেই অনুমোদিত। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে সরকারের অনুমোদন থাকলে আত্মীয় নন এমন যে কেউ কিডনি দান করতে পারেন। কিন্তু এই আইনি প্রক্রিয়াকে ফাঁকি দিয়ে দালালচক্র ভুয়া পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি করে কিডনি প্রতিস্থাপনের পথ সুগম করে। কখনো কখনো তৈরি করা হয় ভুয়া ডিএনএ রিপোর্টও। এ বিষয়ে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অঙ্গসংগঠন ‘অর্গান ট্রান্সপ্লানটেশন টাস্কফোর্স’-এর সদস্য ড. মনিরুজ্জামান বলেন, এই প্রতারণার পদ্ধতিগুলো প্রায় একই রকম। নাম পরিবর্তন, ভুয়া নোটারি সনদ, আত্মীয় হিসেবে প্রমাণের জন্য জাল জাতীয় পরিচয়পত্র ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। কালাই উপজেলার বাইগুনি গ্রামে সফিরুদ্দিনের গল্পটি আলাদা কিছু নয়। প্রায় ছয় হাজার মানুষের এই গ্রামে এত বেশি সংখ্যক মানুষ কিডনি বিক্রি করেছেন যে, স্থানীয়ভাবে জায়গাটি পরিচিত হয়ে উঠেছে ‘এক কিডনির গ্রাম’ নামে। ২০২৩ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল গ্লোবাল হেলথ-এ প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, কালাই উপজেলায় প্রতি ৩৫ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে একজন কিডনি বিক্রি করেছেন। অধিকাংশ বিক্রেতাই ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সী পুরুষ, যারা চরম দারিদ্র্যের মুখে পড়ে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ কেউ ঋণের চাপে, কেউবা মাদকাসক্তি কিংবা জুয়ায় আসক্তির কারণেও এ পথ বেছে নিয়েছেন।


Share This Post

শেয়ার করুন

Author:

Note For Readers: The CEO handles all legal and staff issues. Claiming human help before the first hearing isn't part of our rules. Our system uses humans and AI, including freelance journalists, editors, and reporters. The CEO can confirm if your issue involves a person or AI.