সরকারের অবস্থান ও চ্যালেঞ্জ : অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার তথ্য ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানান, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টে এআই প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে নির্দেশনা রয়েছে। তিনি বলেন, “পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো চাইলে এই আইনের আওতায় ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে সবাইকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব নয়।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, পূর্ববর্তী সরকার মেটা ও ইউটিউবের কাছে অপতথ্য সংবলিত কনটেন্ট অপসারণের অনুরোধ করলেও সব ক্ষেত্রে তা কার্যকর হয়নি। “আমরা মেটাকে তাদের কমিউনিটি গাইডলাইন কঠোরভাবে মেনে চলতে বলেছি। কিন্তু তারা এই খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী নয়,” বলেন তিনি। তিনি জানান, দেশে ডিজিটাল সাক্ষরতার ঘাটতির কারণে মানুষ সহজেই এআই-চালিত ভুয়া কনটেন্টে বিশ্বাস করে।
মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি: অপতথ্যের একটি উদাহরণ :গত ২১ জুলাই ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনা জাতীয় শোকের রূপ নেয়। এই ট্র্যাজেডির মধ্যেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এআই-চালিত ভুয়া ভিডিও ভাইরাল হয়, যেখানে দাবি করা হয়, এটি বিমান বিধ্বস্তের দৃশ্য। ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা রিউমার স্ক্যানার নিশ্চিত করে, এই ভিডিওগুলো গুগলের ভিইও-এআই টুল দিয়ে তৈরি কল্পিত দৃশ্য। ভিডিওতে ভুল বানান, ভবনের অসামঞ্জস্যপূর্ণ গঠন—এসবই এআই-উৎপন্ন বিভ্রান্তির প্রমাণ। এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয়, সংবেদনশীল মুহূর্তেও এআই প্রযুক্তি জনমনে ভুল বার্তা ছড়াচ্ছে।
নির্বাচনকে ঘিরে উদ্বেগ : আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এআই-চালিত অপতথ্যের বিস্তার উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছেছে। ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা ডিসমিসল্যাবের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত জুন-জুলাই মাসে ৭০টির বেশি এআই-চালিত রাজনৈতিক ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে, যার দর্শক সংখ্যা ২৩ মিলিয়ন ছাড়িয়েছে। এসব ভিডিওতে নারী, রিকশাচালক, ফল বিক্রেতাদের কল্পিত চরিত্রে দেখিয়ে রাজনৈতিক দলের সমর্থক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বিশেষ করে নারী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ডিপফেক ভিডিওর মাধ্যমে ডিজিটাল সহিংসতা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে, যা নির্বাচনের সময় আরও তীব্র হতে পারে।
সাইবার অ্যান্ড জেন্ডার-বেসড ভায়োলেন্স ইন বাংলাদেশ জানায়, এ বছরের প্রথমার্ধে এআই-চালিত ডিজিটাল সহিংসতার শিকার ৭৬ শতাংশই নারী, যাদের অনেকেই রাজনীতিতে সক্রিয়। একশনএইড বাংলাদেশের জরিপে দেখা গেছে, ৬৪ শতাংশ নারী অনলাইনে এআই-চালিত হয়রানির শিকার, যার ৭০ শতাংশই শ্লীলতাহানিমূলক কনটেন্ট। এই প্রবণতা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি করছে।
প্রযুক্তিবিদদের মতামত : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “এআইর ইতিবাচক দিক থাকলেও এর নেতিবাচক ব্যবহার রোধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা প্রয়োজন। ভিজিল্যান্স টিম, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকদের সক্রিয় ভূমিকা এবং জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি।”
লন্ডনভিত্তিক একটি কোম্পানির প্রযুক্তি বিভাগের প্রধান শামীম সরকার বলেন, “নির্বাচনের আগে এআই-চালিত অপপ্রচার কয়েকশ গুণ বাড়বে, বিশেষ করে নারী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে। আইনি নীতিমালা, মিডিয়া সাক্ষরতা, ফ্যাক্ট-চেকিং প্ল্যাটফর্ম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সমন্বয়ে এটি রোধ করা প্রয়োজন।”
এআই অপব্যবহারের কারণ ও প্রভাব : এআই টুল যেমন হেযেন, ডিপফেইসল্যাব, সিনথেটিকস ইত্যাদি সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী হওয়ায় যে কেউ বাস্তবসদৃশ ভুয়া কনটেন্ট তৈরি করতে পারছে। ফলে রাজনৈতিক বার্তা কল্পনার খেলায় পরিণত হচ্ছে, এমনকি সত্যকেও এআই-জেনারেটেড বলে অস্বীকার করা হচ্ছে। প্রযুক্তিবিদরা জানান, নেতিবাচক কনটেন্ট বেশি ভাইরাল হয়, যা মানুষের মনে বিভ্রান্তি তৈরি করে। মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির মতো ঘটনায় ৫০টির বেশি এআই-চালিত ভুয়া ভিডিও তৈরি হয়েছে, যা জাতীয় দুর্যোগকেও বিকৃত করেছে।
সমাধানের পথ: প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, এআই-চালিত অপতথ্য রোধে বহুমাত্রিক পদক্ষেপ প্রয়োজন। প্রথমত, এআই-চালিত ভুয়া কনটেন্টকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ডিপফেক শনাক্তকরণ টুল ও চেইনভিত্তিক তথ্য যাচাই ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। তৃতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে এআই কনটেন্ট শনাক্ত ও অপসারণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। অধ্যাপক মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “একটি শক্তিশালী মনিটরিং টিম গঠন করা হলে অপপ্রচারকারীরা সতর্ক হবে।”
শামীম সরকারের মতে, সরকারের উচিত ফেসবুক, এক্স, ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে আলোচনায় বসে এআই কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। তিনি বলেন, “নির্বাচনের আগের দুই মাস ও নির্বাচিত সরকার শপথের আগ পর্যন্ত এআই-চালিত অপতথ্য সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।”
বাংলাদেশে এআই প্রযুক্তির অপব্যবহার তথ্যের নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনের আগে এই প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে আইনি, প্রযুক্তিগত ও সামাজিক সচেতনতার সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি। অন্যথায়, এআই-চালিত অপতথ্য দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে।