ঢাকা, ২৭ জুলাই, ২০২৫ – বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) ফাইভ-জি প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ‘৫-জি উপযোগীকরণে বিটিসিএলের অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন’ নামের এই প্রকল্পটি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সময় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম কেনাকাটা প্রক্রিয়া আটকে দিয়েছিলেন এবং তদন্তের ব্যবস্থা করেছিলেন।
কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব যন্ত্রপাতি কেনার তোড়জোড় শুরু করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে দুদককে প্রভাবিত করার অভিযোগও উঠেছে।
দুদক গত ৯ জানুয়ারি তদন্ত শুরু করে, পরিচালক এস এম এম আকতার হামিদ ভূঁইয়ার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। তদন্ত চলাকালীন ফয়েজ আহমদ দুদকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং চিঠি দিয়ে কেনাকাটা প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন, যা প্রভাব বিস্তার ও কৌশলের অভিযোগ তুলেছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুমোদিত এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ১,০৫৯ কোটি টাকা, যার মধ্যে যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ৪৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দ। দরপত্রে তিনটি প্রতিষ্ঠান অংশ নিলেও কেউ শর্ত পূরণ করতে পারেনি বলে অভিযোগ ওঠে। তবুও চীনা প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে টেকনোলজিসকে ৩২৬ কোটি টাকার কাজ দেওয়া হয়। বুয়েটের সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রয়োজনের তুলনায় পাঁচ গুণ সক্ষমতার যন্ত্রপাতি কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যা অর্থ অপচয়ের অভিযোগ তুলেছে। তৎকালীন মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ও সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানের বিরুদ্ধে গোপন তথ্য ফাঁস ও প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ ওঠে।
তৎকালীন বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান গোপনীয়তা লঙ্ঘনের কারণে দরপত্র বাতিল করেন এবং দুটি চীনা প্রতিষ্ঠানকে অযোগ্য ঘোষণা করেন। কিন্তু মোস্তাফা জব্বার এডিপি সভায় বাতিলের সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও সচিবের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়। আসাদুজ্জামানের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে অপসারণ করে বিভাগীয় মামলা দেওয়া হয়। নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের পর হুয়াওয়েকে কাজ দেওয়া হয়।
নথিপত্রে দেখা যায়, তৎকালীন যুগ্ম সচিব তৈয়বুর রহমান দরপত্রের অগ্রগতি জানতে চিঠি দেন এবং পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করা হয়। ২০২৪ সালে আবু হেনা ও তৈয়বুর একটি বই লিখে বঙ্গবন্ধু ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উৎসর্গ করেন। আবু হেনাকে স্থানীয় সরকার বিভাগে স্থানান্তর ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। তৈয়বুর বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের যুগ্ম সচিব, ইডিজিই প্রকল্পের পরিচালক ও জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সির মহাপরিচালক।
**ফয়েজের তৎপরতা**
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নাহিদ ইসলাম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হন, কিন্তু ২০২৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে পদত্যাগ করেন। ৫ মার্চ ফয়েজ আহমদকে বিশেষ সহকারী নিয়োগ করা হয়। তিনি আওয়ামী লীগ আমলে কেনা যন্ত্রপাতি আমদানির উদ্যোগ নেন। চুক্তি অনুযায়ী, চীনে হুয়াওয়ের কারখানায় চারজন প্রকৌশলী পাঠিয়ে যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করার কথা। কিন্তু ফয়েজ ২০ দিনের মধ্যে কারখানা পরিদর্শনের জন্য হুয়াওয়েকে চিঠি দেন।
বিটিসিএল নিজস্ব আইনজীবী প্যানেল থাকা সত্ত্বেও ২৭ মার্চ বেসরকারি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মতামত নেয়। প্রতিষ্ঠানটিকে দুর্নীতির অভিযোগ জানানো হয়নি, ফলে প্রাথমিক মতামত কেনাকাটার পক্ষে আসে। পরে (৮ এপ্রিল) তারা অনিয়মের কথা জেনে মতামত সংশোধন করে, পিপিএ ২০০৬ ও পিপিআর ২০০৮-এর ধারা উল্লেখ করে সতর্ক করে।
সিপিটিইউর সাবেক মহাপরিচালক ফারুক হোসেন বলেন, এ ধরনের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তারা কেনাকাটা এগিয়ে নেন না। তবুও ফয়েজ ১৩ এপ্রিল দুদকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং চিঠি দেন। দুদক ১৮ জুন জানায়, ক্রয় আইন লঙ্ঘনের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাই কেনাকাটা এগিয়ে নিলে আইনের ব্যত্যয় হবে। ২২ জুন ফয়েজ আবার চিঠি দিয়ে প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন।
ফয়েজের বক্তব্য জানতে চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। আইসিটি বিভাগের পিআরও জসীম উদ্দিন জানান, ফয়েজ ৭ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বিটিসিএলের সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রয়োজন, এবং তিনি দুদকের সহযোগিতা চেয়েছেন, কোনো নির্দেশ দেননি।
**হুয়াওয়ের পদক্ষেপ**
১৬ এপ্রিল বিটিসিএল পাঁচজনের একটি দল (দুজন প্রকৌশলী, তিনজন বিভাগীয় কর্মকর্তা) কারখানা পরিদর্শনে পাঠানোর জন্য চিঠি দেয়, যা নিয়মবহির্ভূত। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর জিও আটকে দেয়। ফয়েজ ৬-৯ মে চীন সফর করেন চায়নিজ এন্টারপ্রাইজেস অ্যাসোসিয়েশনের খরচে।
১৮ মে হুয়াওয়ে জানায়, সরকার কারখানা পরিদর্শনের অনুমতি দেয়নি, তাই তারা নিজেরাই পরীক্ষা করবে। ১৯ মে তারা খরচ সমন্বয় ও জাহাজীকরণের অনুমতি চায়। ১৫ মে’র একটি চিঠি হুয়াওয়ের কাছে পৌঁছায়, যা গোপনীয়তা লঙ্ঘনের প্রশ্ন তুলেছে। হুয়াওয়ে দাবি করে, তারা চিঠিটি আনুষ্ঠানিকভাবে পেয়েছে।
বিটিসিএল জাহাজীকরণের অনুমতি না দিয়ে বিভাগের মতামত চায়। ২৫ মে বিভাগ ফয়েজের নির্দেশনা উল্লেখ করে বলে, যন্ত্রপাতির উপযোগিতা যাচাই করা হবে। হুয়াওয়ের প্রস্তাব মেনে জিসিসি ক্লজ ৩৮.৪ অনুযায়ী জাহাজীকরণের কথা বলা হয়। প্রকল্প পরিচালক ২৬ মে চিঠিটি হুয়াওয়েকে পাঠান। হুয়াওয়ে ১৬ জুন জানায়, যন্ত্রপাতি ২২ জুন চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাবে, তবে এটি পৌঁছেছে কি না, নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ব্যাংক সূত্র জানায়, আমদানির নথি জমা পড়েনি, এবং দুদক নথি সংগ্রহ করায় টাকা ছাড় নিয়ে সংশয় রয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তদন্তাধীন প্রকল্পের কেনাকাটা এগিয়ে নেওয়া দুর্নীতি সহায়ক। সরঞ্জাম না কিনলে আইনি জটিলতা ও কিনলে অর্থ অপচয়ের আশঙ্কা রয়েছে। তিনি নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ দিয়ে পর্যালোচনার পরামর্শ দেন, অন্যথায় ভিন্ন উদ্দেশ্যের সন্দেহ জাগে।
Note For Readers:
The CEO handles all legal and staff issues. Claiming human help before the first hearing isn't part of our rules.
Our system uses humans and AI, including freelance journalists, editors, and reporters.
The CEO can confirm if your issue involves a person or AI.