ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ
ঢাকা, ১৫ জুলাই, ২০২৫ – যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতির কারণে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে, বলেছেন অধ্যাপক গোলাম রসুল। ২০২৫ সালের এপ্রিলে ঘোষিত “রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ” নীতির লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্রের দেশীয় শিল্প পুনরুজ্জীবিত করা, বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং “অন্যায্য বিদেশি বাণিজ্য” প্রতিরোধ করা। এই নীতির আওতায় সব আমদানির ওপর ১০% সর্বজনীন শুল্ক এবং যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে, তাদের জন্য অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের রপ্তানি-নির্ভর অর্থনীতির জন্য মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য তুলনামূলকভাবে কম হলেও, ৩৫% অতিরিক্ত শুল্কের কারণে বাংলাদেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের গড় শুল্ক ছিল ১৫%, নতুন শুল্ক যুক্ত হওয়ায় কার্যকর শুল্ক এখন প্রায় ৫০%, যা তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতের প্রতিযোগিতার সক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই খাত বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮০% এর বেশি এবং প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক, যাদের অধিকাংশ নারী, এর ওপর নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় একক রপ্তানি বাজার, যেখানে বছরে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) জানিয়েছে, শুল্ক বৃদ্ধির কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অর্ডার ১৫-২০% কমে যেতে পারে। এর ফলে কাঁচামাল, প্যাকেজিং, পরিবহন ও ব্যাংকিং খাতে প্রভাব পড়বে এবং কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ভিয়েতনাম, যারা আলোচনার মাধ্যমে ২০% শুল্ক নিশ্চিত করেছে, এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো তুলনামূলক কম শুল্কের সুবিধা পাচ্ছে, যা বাংলাদেশের বাজার হারানোর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এই নীতি বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ন্যায্য বাণিজ্য নীতির লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হচ্ছে, কারণ এটি রাজনৈতিক ও কৌশলগত অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আরোপিত। বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় যুক্ত হয়েছে এবং কৃষি, বিমান চলাচল ও জ্বালানি খাতে বাণিজ্যিক সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করছে। শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩ লাখ টন গম আমদানির জন্য সম্মত হয়েছে, যার মূল্য ভারত, রাশিয়া বা ইউক্রেনের তুলনায় প্রতি টনে ২০-২৫ ডলার বেশি হতে পারে। এছাড়া, বোয়িং বিমান, তুলা, গ্যাস টারবাইন, সেমিকন্ডাক্টর ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানিতে শুল্ক সমন্বয়ের বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে। তবে এই পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ব্যয়বহুল হতে পারে, বাজেট ঘাটতি ও মূল্যস্ফীতি বাড়াতে পারে এবং পোশাক শিল্পের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি করে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমাতে পারে। পারস্পরিক বাণিজ্য সুবিধা না থাকলে এই একতরফা ব্যয়বহুল আমদানি দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। অধ্যাপক রসুল সতর্ক করে বলেছেন, এই ধরনের পদক্ষেপ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বৈশ্বিক বাজারে অবস্থানকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, এই শুল্কনীতি বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যার মধ্যে রাশিয়া বা ইরানের মতো নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য সীমিত করা বা তৃতীয় দেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধির সঙ্গে সমান হারে শুল্ক আরোপের শর্ত জড়িত থাকতে পারে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে টিকফার মাধ্যমে কূটনৈতিক সংলাপ জোরদার করতে হবে, বিকল্প বাজার খুঁজতে হবে, পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে এবং ন্যায্য বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থার পক্ষে সক্রিয় অবস্থান নিতে হবে, যাতে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা ও টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়।