তারল্য সংকটে জর্জরিত দুর্বল ব্যাংকগুলো
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দুর্বল ব্যাংকগুলো তীব্র তারল্য সংকটের সম্মুখীন, যা গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থতা এবং বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের কারণে আরও জটিল হয়ে উঠেছে। গ্রাহকদের লাগাতার চাপ এবং খেলাপি ঋণের ভারে এসব ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে, গ্রাহকরা ধীরে ধীরে এসব ব্যাংকের প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন।
গত কোরবানির ঈদের আগে অনেক গ্রাহক তাদের আমানতের টাকা তুলতে না পারায় পশু কিনতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে বারবার আশ্বাস দেওয়া হলেও সময়মতো টাকা ফেরত না পাওয়ায় গ্রাহকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ব্যাংকগুলোর দাবি, তাদের অবস্থা ক্রমান্বয়ে উন্নতির দিকে, কিন্তু প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি "শাক দিয়ে মাছ ঢাকার" মতো কৌশল, যেখানে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত দুর্বলতা আড়াল করা হচ্ছে।
মার্জারের ঘোষণা ও গ্রাহক-কর্মচারীদের উদ্বেগ
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর পাঁচটি দুর্বল ইসলামী ব্যাংক—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংক—একীভূতকরণের ঘোষণা দিয়েছেন। এই ঘোষণার পর এসব ব্যাংকে অস্থিরতা আরও বেড়েছে। গ্রাহকরা তাদের আমানত তুলে নিতে প্রতিদিন ব্যাংক শাখায় ভিড় করছেন, যদিও গভর্নর বারবার আশ্বাস দিয়েছেন যে মার্জারের ফলে কোনো আমানতকারী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। তিনি বলেছেন, এই পদক্ষেপ গ্রাহকদের আমানতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই নেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে, মার্জারের ঘোষণা ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চাকরি হারানোর ভয় তৈরি করেছে। তবে গভর্নর জানিয়েছেন, মার্জারের কারণে কোনো কর্মচারীকে চাকরি হারাতে হবে না। এই পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর ভবিষ্যৎ কোন পথে যাবে—মার্জারের দিকে, নাকি অন্য কোনো সমাধানের দিকে—তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
দুর্বলতার মূল কারণ
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে আর্থিক খাতে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি, জালিয়াতি এবং অর্থপাচারের কারণে ব্যাংকিং খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংকগুলোতে পরিকল্পিতভাবে লুটপাট চালানো হয়েছে। সরকারের প্রকাশ্য মদদে ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ভুয়া ঋণের নামে লাখ লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। এসব ঋণ বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়মিত দেখানোর ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কৃত্রিমভাবে কম দেখানো হয়েছিল।
গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ব্যাংকগুলোর প্রকৃত চিত্র প্রকাশ পেতে শুরু করে। যথাযথ শ্রেণিকরণের মাধ্যমে খেলাপি ঋণের পরিমাণ উন্মোচিত হওয়ায় এটি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, কিছু দুর্বল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৯০ শতাংশেরও বেশি, গড়ে প্রায় ৮০ শতাংশ। মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা ক্রমাগত বাড়ছে। এই ঋণের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের সাবেক নেতা ও তাদের সহযোগী ব্যবসায়ীদের হাতে, যারা এখন দেশ ছেড়ে পলাতক। তাদের সম্পদ বিদেশে পাচার হওয়ায় ঋণ উদ্ধারের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
সরকারের উদ্যোগ
দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে এবং আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষায় সরকার ‘ব্যাংক রেজ্যুলেশন অধ্যাদেশ-২০২৫’ জারি করেছে। এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকের শেয়ার অধিগ্রহণ, সম্পদ ও দায় তৃতীয় পক্ষের কাছে হস্তান্তর, পুনর্গঠন, একীভূতকরণ বা অবসায়নের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এছাড়া, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আইডিবি’র মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে তহবিল সংগ্রহ করে দুর্বল ব্যাংকগুলোর পুনর্গঠন করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে এবং আন্তর্জাতিক অডিট ফার্মের মাধ্যমে সম্পদের গুণগত মান যাচাই সম্পন্ন করেছে।
মার্জারের সম্ভাবনা
পাঁচটি ইসলামী ব্যাংকের একীভূতকরণের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী ইসলামী ব্যাংক গঠনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি বিনিয়োগ ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিনিয়োগের ৭৭ শতাংশ। প্রভিশন ঘাটতি ৭৪ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। এই বিপুল খেলাপি ঋণের কারণে এসব ব্যাংকের টিকে থাকা অসম্ভব। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, ৩০ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ থাকলে ব্যাংক অবসায়ন করতে হয়। তবে, দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় সরকার মার্জারের পথ বেছে নিয়েছে।
মার্জারের ফলে নতুন ব্যাংকটি সরকারি তদারকির আওতায় আসবে, যা গ্রাহকদের আস্থা ফিরিয়ে আনবে। নতুন নামকরণ ও লাইসেন্সের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরি হবে। মন্দ সম্পদ তৃতীয় পক্ষের কাছে হস্তান্তর করায় ব্যাংকটি উন্নয়নমূলক কাজে মনোনিবেশ করতে পারবে। এছাড়া, ৭৫৯টি শাখা, ৬৯৮টি উপশাখা, ৫০৯টি এজেন্ট ব্যাংকিং কেন্দ্র এবং ১০২৩টি এটিএম নিয়ে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক গড়ে উঠবে, যা ইসলামী ব্যাংকিংয়ের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
দুর্বল ব্যাংকগুলোর সংকট সমাধানে মার্জার একটি কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। সরকারের উদ্যোগ, আন্তর্জাতিক সহায়তা এবং কঠোর তদারকির মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তবে, পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা এবং খেলাপি ঋণ উদ্ধারের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এই প্রক্রিয়া সফল হলে দেশের ইসলামী ব্যাংকিং খাত শক্তিশালী হবে এবং জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপিত হবে।
এ.আই/এম.আর