কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া ২১ মে ২০২৫ : বৈধভাবে কাজের সুযোগ না পেয়ে হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় যাচ্ছেন, যেখানে তারা আটক, নির্বাসন এবং মানবেতর জীবনযাপনের মুখোমুখি হচ্ছেন। কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ দূতাবাস এই সমস্যার কথা স্বীকার করলেও আটক শ্রমিকদের সঠিক সংখ্যা জানাতে পারেনি, যা অভিবাসন খাতে গুরুতর ঘাটতির ইঙ্গিত দেয়।
১৯ মে ২০২৫, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিএস-৩১৬ ফ্লাইটে ৪০ জন বাংলাদেশি শ্রমিককে কুয়ালালামপুর থেকে ফেরত পাঠানো হয়। তারা টুরিস্ট ভিসায় মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করে শ্রমিক হিসেবে কাজ করার চেষ্টা করছিল聿ি। এই ৪০ জন ব্যক্তি ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা ব্যয় করে এই ভিসা নিয়েছিলেন। মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন পুলিশ তাদের আটক করে ফেরত পাঠায়। প্রতিবেদনে জানা যায়, কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে প্রায় ১,০০০ শ্রমিক আটকা পড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন, এবং দেশজুড়ে অভিবাসী ক্যাম্পে আরও কয়েক হাজার শ্রমিক আটক রয়েছেন।
ব্যক্তিগত দুর্দশার গল্প
মুন্সীগঞ্জের হেলেনা বেগম ফেরত আসা শ্রমিকদের একজন। কালবেলাকে তিনি জানান, ১৬ মে সকালে স্থানীয় দালালের মাধ্যমে সাড়ে তিন লাখ টাকা সুদে ধার করে মালয়েশিয়া যান। তাকে ২২ দিনের টুরিস্ট ভিসা দেওয়া হয় এবং এয়ারপোর্টে কন্ট্রাক্টর নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ইমিগ্রেশন পুলিশের সন্দেহে তিন দিন পর তাকে ফেরত পাঠানো হয়। হেলেনা বলেন, “স্বামী মারা যাওয়ার পর দুই সন্তান নিয়ে কষ্টে আছি। দালালের প্রলোভনে এসেছিলাম।” তিনি জানান, বিমানবন্দরে প্রায় ১,০০০ লোক আটক, যাদের বেশিরভাগ বাংলাদেশি।
শরিয়তপুরের ইলিয়াস হোসেন একই ফ্লাইটে ফিরেছেন। তিনি জানান, ১৬ মে সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে কুয়ালালামপুর পৌঁছে দালালকে ১ লাখ টাকা দেন। দালাল দুই দিন ঘুরিয়ে খাবার-পানি ছাড়া রেখেছেন। “বিমানবন্দরের দোকান থেকে খাবার কিনেছি, যাদের টাকা ছিল না তারা না খেয়ে ছিল,” বলেন ইলিয়াস। ১৮ মে ইমিগ্রেশন তাকে আটক করে, একদিন জেলে রাখে এবং ১২০ রিঙ্গিত জরিমানার পর ফেরত পাঠায়। শাহ আলম নামে দালাল তার কাছ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা নিয়েছেন। ইলিয়াস বলেন, বিমানবন্দরে ১,০০০-এর বেশি মানুষ আটক, যাদের ফিরতি টিকিট বা জরিমানার টাকা না থাকলে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। যশোরের পাইকগাছার রবিউল হোসেন একই তথ্য দেন।
মালয়েশিয়ার অভিযান ও দূতাবাসের প্রতিক্রিয়া
মালয়েশিয়ার সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষা সংস্থা (একেপিএস) জানায়, ছয় ঘণ্টার মধ্যে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে না যাওয়ায় ১১২ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ৩০০ বিদেশির মধ্যে এদের শনাক্ত করা হয়, যারা দালালের জন্য অপেক্ষা করছিল বলে সন্দেহ করা হয়। আটকদের মধ্যে বাংলাদেশি, ভারতীয় ও পাকিস্তানি নাগরিক ছিলেন। তাদের আরও তদন্তের জন্য একেপিএসের মনিটরিং ইউনিটে নেওয়া হয় এবং প্রবেশ প্রত্যাখ্যান করা হয়।
দূতাবাসের কাউন্সিলর প্রনব কুমার ভট্টাচার্য্য কালবেলাকে বলেন, টুরিস্ট ভিসা ও ঝুঁকিপূর্ণ নৌপথে শ্রমিকরা অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাচ্ছেন। অসাধু রিক্রুটিং ও ট্রাভেল এজেন্সিগুলো এই চক্র চালায়, ফলে শ্রমিকরা ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করেন। তবে দূতাবাসের সঠিক সংখ্যা না জানার বিষয়টি সমন্বয় ও তদারকির ঘাটতি তুলে ধরে।
দালালদের ভূমিকা ও সিস্টেমিক সমস্যা
বায়রা জানায়, ফকরুল ইসলাম ও আফিয়া ওভারসিজের আলতাব খান অবৈধ অভিবাসন চক্র চালান। ফকরুল, বারিধারার হিউম্যান রিসোর্স লিমিটেডের সঙ্গে যুক্ত, বৈধ অভিবাসনের বিরোধিতা করেন। ১৯ মে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে তার সাংবাদিক সম্মেলন বায়রা সদস্যদের ক্ষোভের মুখে পড়ে। আলতাব, মানবপাচার মামলায় জামিনে থেকেও অবৈধ কার্যক্রম চালান। তারা টেকনাফ, কক্সবাজার ও পটুয়াখালী থেকে নৌপথে মানবপাচারে জড়িত বলে অভিযোগ।
বায়রার এক নেতা নাম প্রকাশ না করে বলেন, একটি গ্রুপ সরকারের শ্রমবাজার উন্মুক্তকরণে বাধা দেয়, কারণ বৈধ শ্রমিক পাঠানো তাদের অবৈধ ব্যবসা হুমকির মুখে ফেলে। এটি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং মালয়েশিয়ার রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়।
ব্যবস্থার আহ্বান ও সাম্প্রতিক উন্নয়ন
বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, “শ্রমিকরা যে কোনো উপায়ে কাজ চায়। বৈধ পথ না থাকলে অবৈধ পথ বেছে নেয়। অবৈধ শ্রমিক পাঠানো বন্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।” তিনি কঠোর নিয়ন্ত্রণের আহ্বান জানান।
মালয়েশিয়ার ‘অভিবাসী প্রত্যাবাসন কর্মসূচি ২.০’ (১৯ মে ২০২৫) অবৈধ শ্রমিকদের ৩০০-৫০০ রিঙ্গিত জরিমানায় ৩০ এপ্রিল ২০২৬ পর্যন্ত স্বেচ্ছায় ফিরতে দেবে। ৮ মে ঘোষিত বৈধকরণ প্রক্রিয়া শ্রমিকদের বৈধ হওয়ার সুযোগ দেবে। তবে, ২০২৫-কে ‘এনফোর্সমেন্ট বর্ষ’ ঘোষণা করে মালয়েশিয়া অভিযান জোরদার করেছে, এপ্রিলে ১৬৫ বাংলাদেশিসহ ৫০৬ জন আটক হয়েছেন।
বৃহত্তর প্রভাব
এই সংকট বাংলাদেশের অভিবাসন কাঠামোর ব্যর্থতা এবং মালয়েশিয়ার কঠোর ইমিগ্রেশন নীতির দুর্বলতা তুলে ধরে। দালালদের শোষণ, দূতাবাসের তথ্যের অভাব এবং বৈধ পথের সীমাবদ্ধতা দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা, কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং বৈধ অভিবাসন পথ উন্মুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে। নইলে হাজার হাজার শ্রমিক তাদের সঞ্চয় ও জীবন ঝুঁকিতে ফেলে এই দুর্দশার শিকার হবেন।
এ.আই/এম.আর